ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার
فقه السنن و الآثار (أدلة السادات الاحناف)
ফিক্হুস সুনানি ওয়াল আছার পরিচিতিঃ
"ফিক্হুস সুনানি ওয়াল আছার' একটি কালজয়ী গ্রন্থ। গ্রন্থটি ফিকহে হানাফীর হাদীসভিত্তিক দলীলের এক অনবদ্য সংকলন। এতে সংকলক হানাফী ফিকহের উল্লেখযোগ্য মাসাঈলের হাদীসভিত্তিক দলীল পেশ করেছেন। সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়ে আমলযোগ্য হাদীসসমূহ সংকলন করেছেন। প্রয়োজনে সনদের উপর নাতিদীর্ঘ আলোচনা করে হাদীসগুলোর শাস্ত্রীয় অবস্থান জানিয়েছেন।
আর এর গ্রন্থকার ছিলেন আল্লামা মুফতি আমীমুল ইহসান রাহিমাহুল্লাহ। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র আলিমে দীন যার গ্রন্থ সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট ও লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। তিনি উসূলে কারখির যে অনন্য উদাহরণ দিয়ে সেটাকে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য উপহার হিসেবে দিতে পেরেছেন তার তুলনা বিরল । মাযহাবি দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি হানাফি মাযহাবের লোক ছিলেন। তিনি এ গ্রন্থটি লেখার মাধ্যমে ইলমে হাদীসের এক বিরাট খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তুলনামূলক ফিকহ শাস্ত্রে এটি একটি সংযোজন হিসেবে ধর্তব্য হয়েছে।
বাস্তব জীবনে আল্লাহর বিধান প্রতিপালনের জন্য ওহির দ্বিতীয় প্রকার, অর্থাৎ হাদীস ও সুন্নাহর গুরুত্ব অপরিসীম। বস্তুত ইসলামি শরীআতের খুঁটিনাটি বিধান জানার ক্ষেত্রে কুরআনের চেয়ে হাদীস বা সুন্নাহর উপরেই আমাদের নির্ভরতা বেশি। কুরআনে 'সাধারণত মূলনীতি বা মূল নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। বিশদ বিবরণ ও বিস্তারিত বিধানাবলি জানার জন্য হাদীসের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো গতি নেই। এই গুরুত্ব বিবেচনায় মুসলিম মনীষীগণ বিভিন্ন বিন্যাসে হাদীস ও সুন্নাহর বিভিন্ন সঙ্কলন প্রস্তুত করেছেন। আল্লামা সাইয়িদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান রাহ, সেসব মূল কিতাব থেকে হাদীস চয়ন করে দীনের মূলনীতি, শাখাগত বিধিবিধান, উৎসাহপ্রদান ও সতর্কীকরণ, তাযকিয়া-ইহসান এবং দুআ ও যিকির ইত্যাদি বিষয়ে ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসার নামে একটি সুবিন্যাস্ত মূল্যবান সঙ্কলন তৈরি করেছেন। বাঙালি পাঠকদের কথা বিবেচনা করে তার বঙ্গানুবাদ উপস্থাপন করেছেন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.। কিতাবটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে দুখণ্ডে (জুন ২০০৯ ও জুন ২০১০ এ ১ম সংস্করণ) প্রকাশিত হয়েছে।
ফিকহুস সুনানি ওয়াল আসার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস সঙ্কলন । হাদীসভিত্তিক ফিকহি এই গ্রন্থে সংকলক মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় কাজকর্মের ইসলামি বিধানসমূহ সঙ্কলন ও উপস্থাপন করেছেন সহীহ হাদীসের দলীলসহ। ফলে ফিকহি মাসআলা সংক্রান্ত হাদীস খুঁজতে এ গ্রন্থটি খুবই সহায়ক।
বস্তুত ইসলামী শরী'আহর জ্ঞানে সম্মৃদ্ধ যিনি, তিনিই ফকীহ বলে বিবেচিত হয়ে থাকেন। পূর্বকালে বলা হত, "যে কেউ আলিমগণের মধ্যকার মতপার্থক্যের জ্ঞান রাখবে না সে ফিকহের গন্ধও শুঁকতে পারবে না।” ফকীহগণের মধ্যে মতভেদ থাকবে না এটা কল্পনা করা যায় না। তাদের মতভেদ আমাদের দীনে প্রশস্ততা নিয়ে এসেছে। তাঁদের মধ্যকার মতভেদ এ দীনের প্রাণবন্ততা ও যুগ-যুগান্তরে, অবস্থা ও পরিবেশের ভিন্নতায় তার প্রয়োগ সম্ভব হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এটিকে বলা হয় ইলমুল খিলাফ। এ খিলাফ বা মতপার্থক্য কখনও উম্মাতের সালাফ তথা পূর্বতন লোকদের মাঝে হানাহানির পর্যায়ে ছিল না। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে বহু ফিকহী মাসআলায় মতভেদ ছিল। কিন্তু কখনও শোনা যায়নি যে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কিংবা এর উপর ভিত্তি করে একে অপরকে ঘায়েল করার জন্য অপমানকর কোনো শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাবিয়িগণের মধ্যে বহু ফিকহী মাসআলায় মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে তা নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ির নমুনা দেখতে পাই না। ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তারা বহু ফিকহী মাসআলায় মতভেদ করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহকে দেখা গেছে আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে মন্তব্য করতে যে, “এ হচ্ছে আবু হানীফা, যদি তিনি এ স্তম্ভটিকে স্বর্ণ বলেন তবে সেটা তার যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দেখাতে পারবেন"। আবার শাফিয়ি রাহিমাহুল্লাহকে দেখা গেছে আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে “কেউ যদি ফিকহে গভীর জ্ঞানী হতে চায় তবে তাকে আবু হানীফার পরিবারভুক্ত হতে হবে” । আবার দেখতে পাই শাফিয়িকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানের কাছে পড়েছেন এবং পরবর্তীতে তার উস্তাদ থেকে উটের বোঝার মত ইলম নিয়েছেন বলে গর্ব করতেন। এ শাফিয়িকেই দেখা যায় ইমাম মালিকের ছাত্র হতে। আর ইমাম আহমাদকে দেখা যায় শাফিয়ির ছাত্র হতে। অপর দিকে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেন, যদি হাদীস বিশারদগণ কোনোদিন কোনো কথা বলে তবে তারা শাফিয়ির মুখ দিয়েই বলতে হবে। আহমাদ ইবন হাম্বাল বলেন, আল্লাহ তা'আলা শাফিয়ির মধ্যে সকল কল্যাণের সমাহার করেছেন। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন, আমি আহমাদ ইবন হাম্বালকে দেখেছি শাফিয়ির খচ্চরের পিছনে পিছনে হাটতে। ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন পরবর্তীতে শাফিয়িকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, তুমি যদি অপর পার্শ্ব দিয়ে তার পিছনে চলতে তবে তা তোমার জন্য উপকারী হত। রবী' ইবন সুলাইমান আল-মুরাদী বলেন, শাফিয়ি বলেন, যদি কেউ আহমাদ ইবন হাম্বালের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করে তবে তা তাকে কাফির বানিয়ে ছাড়বে। শাফিয়ি আরও বলেন, আমি বাগদাদ থেকে বের হবার সময় সেখানে আহমাদ ইবন হাম্বালের চেয়ে পরহেযগার, তাকওয়াবান, ফকীহ এবং জ্ঞানী আর কাউকে রেখে আসিনি।
এভাবেই আমরা দেখতে পাই, বড় বড় আলিমগণ ফিকহী মাসআলায় মতভেদ সত্ত্বেও পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং তাদের মধ্যকার সম্মানিত সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাদের মাঝে আকীদাগত কোনো বিরোধ ছিল না। তারা আকীদাগতভাবে একই পরিবারভুক্ত ছিলেন।
ফিকহী মাসআলাগত এ মতভেদের কারণে প্রত্যেক গবেষক আলিমই তাদের গ্রন্থসমূহে তার মাসলাক বা মাযহাবের মতকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন। সাথে সাথে তারা অপর মতকেও সম্মানের সাথে উল্লেখ করে তাদের মত খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন। এসবই করেছেন তারা অত্যন্ত সম্মানের সাথে এবং আদবের সাথে।
পরবর্তীতে এ ধারায় আরো ব্যপকতা সাধিত হয়। আলিমগণের মাঝে মাযহাবি ফিকহের সাহায্য করার প্রবণতা প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখি, ইমাম তাহাবি রাহিমাহুল্লাহ হানাফি মাযহাবের পক্ষে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর কিতাব শারহু মাআনিল আসার সংকলন করেছেন। ইমাম বাইহাকি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর মা'রিফতুস সুনানি ওয়াল আসার রচনা করেছেন ।
আমাদের এ গ্রন্থটি তেমনি একটি গ্রন্থ; যেখানে শাইখ মুফতি আমীমুল ইহসান রাহিমাহুল্লাহ হানাফি মাযহাবের দলীল জমা করতে চেষ্টা করেছেন। অন্যান্য মাযহাবের দলীল নিয়ে এসে হানাফী উসূলের ওপর ভিত্তি করে সেটার উপর নিজের মাযহাবকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব আলোচনার সময় অনেক সময় নিজের দলীলকে সঠিকভাবে পেশ করলেও সর্বত্র অপরপক্ষের সকল দলীল নিয়ে আসা হয়নি। বিষয়টি গবেষক পাঠক মাত্রই বুঝতে সমর্থ হবেন । তার এ গ্রন্থটি অনেক দিক থেকে নীমাবি রাহিমাহুল্লাহর আসারুস সুনান' ও শাইখ যাফার আহমাদ উসমানি রাহিমাহুল্লাহর ইলাউস সুনান' গ্রন্থেরই অনুরূপ।
এ জাতীয় গ্রন্থ যত বেশি রচিত হবে ততই মানুষ দলীলভিত্তিক ফিকহের দিকে ধাবিত হবে। এর মাধ্যমে ইলমে ফিকহের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হবে।
আমরা গ্রন্থখানির প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক ও সাধারণ পাঠকের মাঝে দলীলভিত্তিক ফিকহের ভিত রচিত হবে বলে বিশ্বাস করি ।
কিতাবটিতে রয়েছে ৪৬টি অধ্যায়। বিষয়ের পরিধি ও প্রয়োজনবোধে অনেকগুলো অধ্যায়ে রয়েছে একাধিক পরিচ্ছেদ এবং পরিচ্ছেদগুলোর অধীনে রয়েছে একাধিক অনুচ্ছেদ। গ্রন্থকার প্রত্যেকটি অনুচ্ছেদে প্রথমত একটি হাদীস বা হাদীসের অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন। তারপর প্রয়োজনবোধে বা বিশেষ ফায়দা বিবেচনায় হাদীসটির শাহিদ বা তাবি' হিসাবে এক বা একাধিক হাদীস বা হাদীসের অংশবিশেষ উল্লেখ করেছেন। বিশেষ বিবেচনায় অল্প কিছু টীকায় ছাড়া গ্রন্থকার মূল গ্রন্থে কোনো হাদীসের পূর্ণ সনদ উল্লেখ করেন নি। সনদের শেষ থেকে শুধু সাহাবি অথবা তাবিয়ির নাম এবং সঙ্কলকের নাম উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি সঙ্কলকের প্রসিদ্ধ কিতাবের হলে তিনি টীকায় তার সংগ্রহে থাকা নুসখা থেকে শুধু পৃষ্ঠা ও খণ্ড নাম্বার উল্লেখ করেছেন, অন্যথায় কিতাবের নামও উল্লেখ করেছেন। তবে অনুবাদক সাধারণত শুধু সঙ্কলকের নাম উল্লেখ করেছেন, কিতাবের পৃষ্ঠা ও খণ্ড নাম্বার উল্লেখ করেন নি ।
হাদীসটি সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিমের অথবা এর কোনো একটার হলে গ্রন্থকার সাধারণত অন্যকোনো সঙ্কলকের নাম উল্লেখ করেন নি । অন্যথায় অবগতি অনুযায়ী এক বা একাধিক সম্বলকের নাম উল্লেখ করেছেন। তবে হাদীসটি গ্রন্থকারের উল্লেখের বাইরেও কুতুবে সিত্তাহর অন্যকোনো সঙ্কলনে থাকলে আমরা তা উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি এবং কোনোকোনো ক্ষেত্রে তার বাইরেরও দুয়েকটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি এবং সাধারণত 'মাকতাবা শামিলা' থেকে হাদীস নাম্বার সংযোজন করেছি। যে গ্রন্থটি মাকতাবা শামিলাতে নেই তার উদ্ধৃতিতে পৃষ্ঠা, খণ্ড ও হাদীস নাম্বার আমাদের সংগ্রহে থাকা কপি থেকে দিয়েছি। তবে ইমাম মুহাম্মাদের 'কিতাবুল আসারে'র উদ্ধৃতি সালাত অধ্যায় পর্যন্ত শামিলা থেকে এবং তার পর থেকে দারুস সালাম প্রকাশিত ড. আহমাদ ঈসা মাআসারাবির তাহকীককৃত নুসখা থেকে দিয়েছি ।
যেসব হাদীসের ক্ষেত্রে গ্রন্থকার একাধিক সঙ্কলকের নাম উল্লেখ করেছেন, এমন নয় যে, তাদের সবার সঙ্কলনে হাদীসটি উদ্ধৃত শব্দে হুবহু রয়েছে। বরং কারো কারো সঙ্কলনে হাদীসটি অংশবিশেষ বা মর্মগতভাবে থাকতে পারে । তবে গ্রন্থকার যেহেতু সকল হাদীস সঙ্কলকের মূল গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করতে পারেন নি, বরং কোনো কোনো হাদীস তাখরীজ, যাওয়ায়িদ, শুরুহাত ইত্যাকার গ্রন্থের বরাতে উল্লেখ করেছেন, একারণে দুয়েকটা হাদীসের উদ্ধৃত শব্দে মূল গ্রন্থের শব্দের সাথে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে আমরা 'বরাত' গ্রন্থের নাম উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি- গ্রন্থকার যেটা টীকায় উল্লেখ করেছেন ।
গ্রন্থকার যেসব সঙ্কলকের বর্ণনা গ্রহণ করেছেন তারা হলেন: আবূদ ইবন হুমাইদ, আবু ইউসুফ, আবু উওয়ানা, আবু উবাইদ, আবু ইয়া'লা, আবু দাউদ, আবু নুআইম, আবু বাকর আসবাহানি (ইস্পাহানি), আবু বাকর রাযি, আবু বিশর দাওলাবি, আবু মুসা আসবাহানি, আবু মুহাম্মাদ সারাকুসতি, আবু হাতিম, আবু হানীফা, আব্দুর রাযযাক, আব্দুল্লাহ ইবন আহমাদ, আব্দুল হক, আবুশ শাইখ, আযদি, আলী ইবন মা'বাদ আসরাম, আহমান, আহমাদ ইবন মানী', ইবন আদি, ইবন আসাকির, ইবন আবিদ দুনইয়া, ইবন আবী শাইবা, ইবন আবী হাতিম, ইবন আব্দুল বার, ইবন ওয়াহ্ব, ইবন কানি', ইবন খুযাইমা, ইবন জারীর, ইবন নাজিয়া, ইবন মাজাহ, ইবন মারদাওয়াইহি, ইবন যানজাওয়াইহি, ইবন রাহওয়াইহি, ইবন সা'দ, ইবনুল আনবারি, ইবনুল কাস্তান, ইবনুল জারুদ, ইবনুল মুকরি, ইবনুস সাকান, ইবনুস সুন্নি, ইবন হাজার, ইবন হাযম, ইবন হিব্বান, ইবন হিশাম, ইবরাহীম হারবি, ইসমাঈল কাযি, ইসমাঈলি, ঈসা ইবন আবান, উকাইলি, ওয়াকিনি, কারণি, কাসিম ইবন আসবাগ, খতীব বাগদাদি, খাসসাফ, জাযারি, জুকি, তাবারানি, তাবারি, তায়ালিসি, তালহা ইবন মুহাম্মাদ,তাহাবি, তিরমিযি, দাইলামি, দারাকুতনি, দামীরি, দারিমি, নাসায়ি, নুআইম ইবন হাম্মাদ, ফিরইয়াবি, বাইহাকি, বাগাবি, বাযযার, বুখারি, মালিক, মুসলিম, মুহাম্মাদ, যাইদ ইবন আলী, যিয়া মাকদিসি, শাফিয়ি, সাওরি, সাররাজ, সায়ীদ ইবন মানসুর, সাহনুন, সুবকি, সুয়ুতি, হাকিম, হাকীম তিরমিযি, হারিস ইবন উসামা, হারিসি ইত্যাদি ।
সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম ছাড়া অন্য গ্রন্থের হাদীসের ক্ষেত্রে গ্রন্থকার সাধারণত হাদীসটির সনদের মান উল্লেখ করেছেন। সনদ ত্রুটিযুক্ত হলে সাধারণত হাদীস শাস্ত্রের ইমামদের মতামত তাদের নামসহ উল্লেখ করেছেন। কোথাও কোথাও নিজের তাহকীকের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অনুবাদকের সংযোজিত টীকার ক্ষেত্রে টীকার শেষে সাধারণত 'অনুবাদক' শব্দ লিখিত হয়েছে।
আমরা আশা করি, বাংলাভাষায় হাদীস চর্চা, হাদীসভিত্তিক তুলনামূলক ফিকহ, বিশেষ করে এ অঞ্চলে প্রচলিত হানাফি ফিকহের দালীলিক চর্চায় গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ আবদান রাখবে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে বিশেষ মর্যাদায় বরিত ও সমাদৃত হবে।
মুফতি আমীমুল ইহসান রহ. জীবনীঃ
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের প্রথম খতিব (১৯৬৪-১৯৭৪) ছিলেন মুফতি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী (রহ.)। তিনি ছিলেন দেশের একজন প্রাজ্ঞ আলেম, বহু মুল্যবান গ্রন্থ প্রণেতা, কর্মবীর ও বাংলার এক অতুলনীয় মনীষা।
মুফতি আমীমুল ইহসান রহ. ১৯১১ সালের ২৪ জানুয়ারি (১৩২৯ হিজরী ২২ মুহাররম) সোমবার বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জেলার অন্তর্গত পাঁচনা নামক গ্রামে তার জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মুংগেরী রহ. এর একজন খলিফা ছিলেন। তার বংশ-তালিকা নবী মুহাম্মাদ পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে তার পূর্ব-পুরুষগণ নামের পূর্বে ‘সাইয়্যেদ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
মাত্র তিন মাসে তিনি তার চাচা সাইয়্যেদ আবদুদ দাইয়্যান রহ. এর কাছে পূর্ণ ত্রিশ পারা কুরআন হেফজ করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ৫ বছর।
মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তিনি হযরত বারকাত আলী শাহ রহ.-এর কাছে আরবি ব্যাকরণের (মিজান মুনশায়েব) প্রাথমিক জ্ঞান রপ্ত করেন এবং পাশাপাশি উচ্চতর ফারসি সাহিত্য ও তাজবিদের প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র দশ বৎসর বয়সে তিনি হযরত সাইয়্যেদ বারকাত আলী শাহ এর কাছে কুরআন মাজিদের অনুবাদ, ইলমে সরফ, তাফসীর, হেসনে হাসিন ও ফারসি সাহিত্যের উচ্চতর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন।
১৯২৬ সালে পনের বছর বয়সে মুফতি আমীমুল ইহসান রহ. কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। তিনি ১৯২৯ সালে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩১ সালে ফাযিল ও ১৯৩৩ সালে কামিল (হাদিস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন এবং ‘মুমতাজুল মুহাদ্দিসিন’ উপাধি পান।
১৯৩৪ সালে তিনি তার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মাওলানা মুফতি মুশতাক আহমেদ কানপুরী রহ. এর এর কাছে ‘মুফতি’ সনদ লাভ করেন।
১৯২৭ সালে বাবার ইন্তেকালের পর ছোট ভাই বোনের লালন-পালন ও শিক্ষার দায়িত্ব, পিতার চিকিৎসালয় ও পারিবারিক প্রেস পরিচালনা, গৃহ সংলগ্ন (জালুয়াটুলীস্থ) মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৩৪ সালে তাকে কলকাতার বৃহত্তর জামে মসজিদ ‘নাখোদা মসজিদের’ সহকারী ইমাম ও মাদরাসার প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৩৫ সালে ‘নাখোদা মসজিদ’ এর মাদরাসার দারুল ইফতার প্রধান মুফতির দায়িত্ব দেয়া হয়।
তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে প্রায় লক্ষাধিক ফাতওয়া প্রদান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি নাখোদা মসজিদের ও দারুল ইফতার দায়িত্ব প্রশংসনীয়ভাবে পালন করেন। এইজন্য ১৯৩৫ সালে কলকাতা সরকার তাকে একটি বিশেষ সীলমোহর প্রদান করে যাতে লেখা ছিল ‘গ্রান্ড মুফতি অফ কলকাতা’। তখন থেকে তিনি মুফতি-এ-আযম উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৪৯ সালে তৎকালীন সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদরাসার হেড মাওলানা, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি অবসর গ্রহণের পর মুফতি আমীমুল ইহসান অস্থায়ীভাবে সেই পদে নিয়োগ পান।
১৯৫৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত স্থায়ীভাবে সেই পদে নিযুক্ত ছিলেন। আলিয়া মাদরাসায় কর্মরত অধ্যাপক হিসাবে তিনি ব্যাখ্যাসহ বুখারি শরীফ পড়াতেন। ১৯৬৯ সালের ১ই অক্টোবর উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৫৫ সালে আলিয়া মাদরাসা প্রধানের পদে উন্নীত হবার পর তৎকালীন ঢাকার প্রধান ঈদগাহ পুরানা পল্টন ময়দানে ঈদের জামায়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররম প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন কমিটির চেয়ারম্যান ইয়াহিয়া বাওয়ানীর অনুরোধে এবং মসজিদ কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে মসজিদের খতিব এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এই দায়িত্ব কৃতিত্ব সাথে পালন করেন।তিনি প্রতি শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়াতেন এবং আরবীতে স্বরচিত খুৎবা পড়তেন। খুৎবার বঙ্গানুবাদ পূর্বেই শ্রোতাদেরকে শোনানো হত। অভিনব পদ্ধতিতে অনর্গল বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় তার খুতবা প্রদানের অপূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল বিরল। আরবদেশ থেকে আগত অনেক উচ্চশিক্ষিত আলেম ও রাষ্ট্রনায়ক তার খুৎবা শুনে আবেগাপ্লুত হতেন।
তিনি ২০০ এর অধিক ইলমী গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য কিছু কিতাবের তালিকায় রয়েছে— ইলমে তফসির এবং উসূলে তফসির ইতহাফুল আশরাফ বি হাশিয়াতিল কাশশাফ, আল ইহসানুস সারি বিত তাওযিহ ই তাফসিরই সহিহিল বুখারি, আত তানবির ফি উসূলিত তাফসির আত-তাবশির ফি শরহিত তানবির ফি উসূলিত তাফসির, ইলমে হাদিস এবং উসূলে হাদিস, মিযানুল আখবার, আল ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার, মানাহিজুস সুআদা, উমদাতুল মাযানি বি তাখরিজে আহাদিস মাকাতিবুল ইমামুর রাব্বানী, আল আরবাঈন ফিস্ সালাত আল-আরবাঈন ফিল মাওয়াকিত, আল আরবাঈন ফিস্ সালাতি আলান নবী (সা.), জামে জাওয়ামেউল কালাম, কানযুল উম্মাল, মুকাদ্দামায়ে সুনানে আবু দাউদ, মুকাদ্দামায়ে মারাসিলে আবু দাউদ, লাইল ওয়ান নাহার, মীযানুল আখবার, মিয়ারুল আসার, হাশিয়ায়ুস সাদী, তোহফাতলি আখিয়ার, তালিকাতুল বারকতী, তালখীসুল মারাসিল, আসমাউল মুদিল্লীন ওয়াল মুখতালিতীন, কিতাবুল ওয়ায়েযীন, মিন্নাতুল বারী, ইলমে ফিকহ এবং উসূলে ফিকহ তরীকায়ে হজ্জ, ফাতাওয়ায়ে বারকাতীয়া, তরীকায়ে হজ্জ, আল কুরবাহ ফিল কুরা, হাদিয়াতুল মুসাল্লীন, আত¦নবীহ লীল ফকীহ, লুববুল উসূল, মালাবুদ্দা লিল ফকীহ, আত-তারীফাতুল ফিকহিয়্যাহ, উসূলুল কারখী, উসূলুল মাসায়েলীল খিলাফিয়্যাহ, কাওয়ায়েদুল ফিকহ, আদাবুল মুফতী, তুহফাতুল বারকাতী বি-শরহে আদাবুল মুফতী, সীরাত গ্রন্থ: আওজায়ুস সিয়ার, আনফাউস সিয়ার, সীরাতে হাবিবে ইলাহ রেসালা-হায়াতে আবদুস সালাম, ইলমে তাসাওউফ, রেসালায়ে তরীকাত, আততাশাররুফ লি আদাবিত তাসাওউফ, তারীখ (ইতিহাস), তারীখে ইসলাম, তারিখে আম্বিয়া, তারিখে ইলমে হাদীস, তারীখে ইলমে ফেকাহ, আল হাভী ফি যিকরিত তাহাভী, তারিফুল ফুনুন ওয়া হালাতে মুসান্নেফিন, নাফয়ে আমীম ইলমে নাহু ও শরফ (ব্যাকরণবিদ্যা), মুকাদ্দমাতুন নাহু, নাহু ফারসী, ওয়াজ ও মিলাদ, মজুমায়ে খুতবাত, মজুমায়ে ওয়াজ, ওয়াজিফায়ে সাদিয়া বারকাতীয়া, শাজারা শরীফা, সিরাজাম মুনীরা ও মিলাদ নামা, উর্দু সাহিত্য: আদবে উর্দু, শরহে শিকওায়াহ ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহ।
১৯৭৪ সালের ২৭ অক্টোবর (১৩৯৫ হিজরীর ১০ই শাওয়াল) ইন্তেকাল করেন। তাকে ঢাকার ৬০নং তনুগঞ্জ লেনে অবস্থিত কলুটোলা মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।